পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের ইয়াকিন পলিমারের শেয়ার দর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিনাকারনেই শেয়ারটির দর এক মাসে বেড়েছে ৯ দশমিক ৭০ টাকা। এসময় শেয়ারটির বাজার মূলধন বেড়েছে ৭১ কোটি টাকা। শেয়ার দরের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নিয়ে কোম্পানির শেয়ার ধারন করা বিনিয়োগকারীদের মাঝে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। অপরদিকে কোম্পানিটিরি শেয়ার দর কেন এতো বাড়ছে, তার প্রকৃত কারন জানে না বলে জানান ইয়াকিন পলিমারের কর্তৃপক্ষ।
পুঁজিবাজারের সংশ্লিষ্টরা বলেন, ইয়াকিন পলিমারের ব্যবসা মন্দা। ফলে শেয়ার দর তলানিতে পড়েছিল। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে কোম্পানিটি লোকসান থেকে লাভে এসেছে। খবরটি প্রকাশের আগেই কোম্পানির শেয়ার দর অস্বাভাবিকহারে বেড়েছে। বৃদ্ধি কারনে শেয়ারটির দর বর্তমানে দ্বিগুণ। এই ধরনের বৃদ্ধি ইনসাইডার ট্রেডিং বলে মনে করছেন তারা। অপরদিকে, ইয়াকিনের ব্যবসার উন্নতির তথ্য প্রকাশের আগেই কোম্পানির কর্তৃপক্ষ অন্যদের মধ্যেমে পুঁজিবাজারে ছড়িয়েছে এমন অভিযোগ করেছে বিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা।
ইনসাইডার ট্রেডিং প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহি পরিচালক ও মূখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ইয়াকিন পলিমারের ব্যবসায়ে উন্নতির খবর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের আগেই শেয়ারের দর বাড়ছে। বিষয়টি কমিশনের নজরে এসেছে। এধরনের বৃদ্ধির পেছনে ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের সম্পৃক্ততা আছে কিনা, তা বিএসইসি খতিয়ে দেখছে। কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে, আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইয়াকিন পলিমারের মোট শেয়ার সংখ্যা ৭ কোটি ৩৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮১৭টি। মাত্র এক মাসে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের বাজার মূল্যে বেড়েছে ৭১ কোটি ৪৮ লাখ ৭৮ হাজার ৫২৪ টাকা। অপরদিকে, এই সময়ে সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের মাধ্যমে বাজার মূল্যে বেড়েছে ৪৯ কোটি ৮৮ লাখ ২৪ হাজার ২৩৪ টাকা। এর মধ্যে শুধু সাধারন বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের মাধ্যমে বাজার মূল্যে বেড়েছে ৩৯ কোটি ৫৩ লাখ ৯৯ হাজার ৩১২ টাকা।
আরও পড়ুনঃ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নয়নের রোল মডেল
ইয়াকিন পলিমারের শেয়ার দর বৃদ্ধির প্রসঙ্গে কোম্পানির সচিব মো. আক্তারুজ্জামানকে ফোনে পাওয়া যায়নি। পরে অন্য ফোনে কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন, শেয়ার দর কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে জানি না। যা বলার ডিএসইকে জানিয়েছে। নতুন করে আমাদের কিছু বলার নেই।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিটির দ্বিতীয় প্রান্তিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যায়, কোম্পানিটি চলতি অর্থবছরের (২০২১-২০২২) দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) লাভে ফিরেছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ৬৪ পয়সা। যেখানে আগের অর্থবছরের (২০২০-২০২১) দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) শেয়ার প্রতি লোকসান ছিল ১২ পয়সা। চলতি অর্থবছরের দুই প্রান্তিকে (জুলাই-ডিসেম্বর) শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ৫০ পয়সা। আগের অর্থবছরের দুই প্রান্তিকে (জুলাই-ডিসেম্বর) শেয়ার প্রতি লোকসান ছিল ৫৬ পয়সা।
এদিকে শেয়ার দর ধারাবাহিকভাবে বাড়ার কারণে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে ইয়াকিন পলিমারকে নোটিশ পাঠিয়েছিল। ওই নোটিশের জবাবে কোম্পানিটি গত ২ ফেব্রুয়ারি ডিএসইকে জানায়, শেয়ার দর এভাবে বাড়ার পেছনে কোনো কারণ নেই।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত দুই বছরে যেখানে ইয়াকিন পলিমারের শেয়ার দর ১৬ টাকার ওপরে উঠতে দেখি নাই, সেখানে গত এক মাসে শেয়ার প্রতি প্রায় ১০ টাকা বেড়ে গত সোমবার দর দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৬০ টাকায়। কোন পরিকল্পনায় শেয়ার দর এভাবে বেড়েছে তার কারণ জানা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষকরা আরো বলেন, নিয়ম অনুসারে শেয়ার দর বাড়া-কমার পেছনে কোম্পানির কর্মকর্তারা কাজ করেন না। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোম্পানির শেয়ার দর বাড়া- কমার তাদের (কর্মকর্তা) অদৃশ্য ছোঁয়া থাকে। তাদের ছোঁয়া ছাড়া কোনো কোম্পানির শেয়ার দর লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যায় না। কারণ তারাই জানেন কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য। যেসব তথ্য শেয়ার বাড়া-কমার ক্ষেত্রে জাদুকরি ভূমিকা রাখে। তাই শেয়ার দর বাড়ার জাদুকরি প্রতিষ্ঠান ইয়াকিন পলিমারের প্রতি বিশেষ নজর দিতে পুঁজিবাজার রেগুরেটরকে অনুরোধ করেন তারা।
আরও পড়ুনঃ কুয়াশার চাদরে ঢাকা লালমনিরহাট
অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কোম্পানির শেয়ার দর দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৬০ টাকা। এর আগে ১৬ জানুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ১২ দশমিক ৯০ টাকা। এক মাসে কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৭০ টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ৭ কোটি ৩৬ লাখ ৯৮ লাখ ৮১৭টি। সেই হিসাবে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটির মোট শেয়ারের বাজার মূল্যে হয়েছে ১৬৬ কোটি ৫৫ লাখ ৯৩ হাজার ২৬৪ টাকা। এক মাস আগে বা ১৬ জানুয়ারি শেয়ারের বাজার মূল্যে ছিল ৯৫ কোটি ৭ লাখ ১৪ হাজার ৭৩৯ টাকা।
এই সময়ের ব্যবধানে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের বাজার মূল্যে বেড়েছে ৭১ কোটি ৪৮ লাখ ৭৮ হাজার ৫২৪ টাকা। মোট শেয়ারের মধ্যে ৫৫ দশমিক ৩১ শতাংশ ধারন করেছে সাধারণ বিনিয়োগকারী। সেই হিসেবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের বাজার মূল্যে বেড়েছে ৩৯ কোটি ৫৩ লাখ ৯৯ হাজার ৩১২ টাকা। ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ ধারন করেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। সেই হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের বাজার মূল্যে বেড়েছে ১০ কোটি ৩৪ লাখ ৪২ হাজার ৯২২ টাকা। মাত্র এক মাসে বাজার মূল্যে এতো বৃদ্ধি, এটা কোনোমতে মানতে রাজি নন, এ কোম্পানির শেয়ার ধারন করা বিনিয়োগকারীরা। তাই শেয়ার দর বাড়ার কারণ জানার জন্য সংশ্লিষ্ট রেগুলেটরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।
২০১৬ সালে পুঁজিবাজারে আসা ‘বি’ ক্যাটাগরি’ ইয়াকিন পলিমারের অনুমোদিত মূলধন ১০০ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ৭৩ কোটি ৩৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। শেয়ার সংখ্যা ৭ কোটি ৩৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮১৭ শেয়ার। রির্জাভ রয়েছে ৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং স্বল্পমেয়াদি লোন ২৪ কোটি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। কোম্পানির মোট শেয়ারের ৩০ দশমিক ৫২ শতাংশ মালিকানা রয়েছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও বাকি ৫৫ দশমিক ৩১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।