শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া, কোম্পানিটির উৎপাদনে ব্যবহ্নত পণ্যের সঙ্গে ধারাবাহিক লোকসান ও উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাসের কোন মিল নেই। এ কারণে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে (সিএসই) একটি বিশেষ অডিট পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)।
সম্প্রতি কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয় ও কারখানা প্রাঙ্গণ পরিদর্শন করে এসব অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে সিএসই কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে সিএসই কোম্পানিটির এসব অভিযোগ প্রতিবেদন আকারে বিএসইসি বরাবরে দাখিল করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এর আগে চলতি বছরের গত ২২ এপ্রিল শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত সাতটি কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে সশরীরে পরিদর্শনের অনুমতি পায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই ও সিএসই) কর্তৃপক্ষ। ওইসব কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ।
উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সশরীরে কোম্পানিটি পরিদর্শনের অনুমতি দেয় বিএসইসি। এ পরিদর্শন কার্যক্রমে কোম্পানিগুলোর আর্থিক সক্ষমতার পাশপাশি কোম্পানিগুলোর উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম যাচাই করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের গত ৫ সেপ্টেম্বর খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান কার্যালয় ও ৬ সেপ্টেম্বর কারখানা প্রাঙ্গণ পরিদর্শন করেছে সিএসই।
পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করা অন্যান্য কোম্পানিগুলো হলো- আমান ফিড, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, নূরানি ডাইং অ্যান্ড সোয়েটার, মোজাফফর হোসেন স্পিনিং মিলস, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস ও কাট্টালি টেক্সটাইল।
পরিদর্শন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে সিএসই উল্লেখ করেছে, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তোফায়েল কবির খান একই সঙ্গে আটটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব করছেন; যা কোম্পানি আইন, ১৯৯৪ এর ধারা ১০৯ এবং করপোরেট গর্ভনেন্স কোডের শর্ত ৩(সি) লঙ্ঘন।
এছাড়া ২০২০ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখিত অডিট রিপোর্টে অডিটর কিছু বিষয়ে আপত্তি হিসেবে গুরুত্বারোপ করেছে। তবে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখিত পরিচালকদের প্রতিবেদনে কোম্পানি আইন ১৯৯৪ এর ধারা ১৮৪(৩) অনুযায়ী কোনো ব্যাখ্যা বা তথ্য প্রদান করা হয়নি। আর করপোরেট গর্ভনেন্স কোড, ২০১৮ এর শর্ত ৩ অনুযায়ী; কোম্পানিটি হেড অব ইন্টারনাল অডিট ও কমপ্লায়েন্স হিসেবে কাউকে নিযুক্ত করেনি।
অপরদিকে কোম্পানিটির সচিব ও প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) একইসঙ্গে খান ব্রাদার্স গ্রুপের একাধিক কোম্পানির দায়িত্ব পালন করছেন; করপোরেট গর্ভনেন্স কোড, ২০১৮ এর শর্ত ৩৩ (ই) লঙ্ঘন। পাশাপাশি কোম্পানিটি চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (লিস্টিং) রেগুলেশন, ২০১৫ এর রেগুলেশন ৪২(৩) অনুযায়ী ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিগত চার বছর ধরে কোনো লিস্টিং ফি প্রদান করেনি।
খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানা পরিদর্শনকালে লক্ষ্য করা গেছে, একটি ট্যাপ লাইন মেশিনারিজ ছাড়া কারখানাটি সম্পূর্ণরূপে চালু আছে। কোম্পানির বন্ডেড গুদাম সম্পূর্ণরূপে কাঁচামালে পূর্ণ ছিল। কিন্তু কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট জানিয়েছে, বর্তমানে কারখানাটি প্রায় ১০ শতাংশ সক্ষমতা নিয়ে কাজ করছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে একই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
কোম্পানিটির ব্যবসা বছরের পর বছর খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে (২০১৫ থেকে ২০২০) কোম্পানির ব্যবসা ৯০ কোটি ৩৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা কমেছে, যা ২০১৫ সালের ব্যবসার তুলনায় ৭৯ শতাংশ কম। বিগত বছরগুলোতে কোম্পানির নিট মুনাফা অনেক বেশি কমেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কোম্পানিটি ৮৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা নিট লোকসান করেছে, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই কোম্পানিটির সার্বিক বিষয় অনুসন্ধানের লক্ষ্যে বিশেষ অডিট পরিচালনা করা যেতে পারে। বিশেষ করে বিশেষ অডিটে আমদানিকৃত কাঁচামালের সঙ্গে সমন্বয়, উৎপাদিত কাঁচামালের ব্যবহার বা ইউনিটের জন্য ব্যবহার, উৎপাদিত ইউনিটের সঙ্গে বিক্রিত ইউনিট; বিগত পাঁচ বছরে কোম্পানিটিসহ গ্রুপের অন্যান্য গুদামে রক্ষিত মালামাল ও গ্রুপের অন্যান্য কোম্পানিতে পণ্য স্থানান্তরসহ মূল্য যাচাই করা যেতে পারে।
এদিকে সিএসই’র প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজের অফিসে কর্মরত বেশিরভাগ কর্মকর্তা খান ব্রাদার্স গ্রুপের অন্যান্য কোম্পানির জন্য একসঙ্গে কাজ করেন। খান ব্রাদার্স ছাড়াও, খান ব্রাদার্স গ্রুপের আরো সাতটি অতালিকাভুক্ত কোম্পানি রয়েছে। আর খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একসঙ্গে ওই সাতটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
একইভাবে, কোম্পানি সচিব তপন কুমার সরকার এবং প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) আজিজুল জব্বার পুরো খান ব্রাদার্স গ্রুপের জন্য দায়িত্ব পালন করছেন। আর কোম্পানিটির কোনো কার্যকরী নমিনেশন অ্যান্ড রেমুনারেশন (এসআরসি) কমিটি নেই।
চেয়ারপারসনসহ অন্যান্য পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের জন্য আচরণবিধি নেই (কোড অব কন্ডাক্ট) এবং বিএসইসির করপোরেট গভর্নেন্স কোড, ২০১৮ এর শর্ত অনুযায়ী কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।
এছাড়া খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ যেখানে অবস্থিত সেখানে খান ব্রাদার্স গ্রুপের অন্য দুটি কোম্পানি রয়েছে। সেগুলো হলো- খান ব্রাদার্স ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ ও খান ব্রাদার্স মার্বেল অ্যান্ড গ্রানাইট। কোম্পানি দুইটি খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজের একই সীমানা প্রাচীরের মধ্যে অভ্যন্তরীণ প্রাচীর ও গেট দ্বারা পৃথক অবস্থায় রয়েছে। ওই কোম্পানি দুইটি খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজের মতোই প্রায় একই ধরণের পণ্য তৈরি করে প্রায় সম্পূর্ণ ক্ষমতায় কাজ করছে। তবে কোম্পানিগুলো অভ্যন্তরীণভাবে পণ্য স্থানান্তর বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সঠিক রেকর্ড ও মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে কিনা তা এখানে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে অনুযায়ী, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ আলোচ্য সময়ে খান ব্রাদার্স ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে লেনদেন করেছে। তবে লেনদেন সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজের বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রদান করেনি বলে জানিয়েছে পরিদর্শক দল।
প্রসঙ্গত, ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০১৪ সালে। ‘বি’ ক্যাটাগরির এ কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ৯ কোটি ৮০ লাখ ৭৯ হাজার ৮৭৮টি। চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালকের হাতে ৩০.১৩ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ২৭.৬৫ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৪২.২২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।