কোম্পানি সংবাদ

মীর আখতারের বিরুদ্ধে কারসাজিসহ নানা তথ্য গোপনের অভিযোগ: তদন্তের দাবি

Written by Pujibazar Express

ইপিএসে কারসাজিসহ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মীর আখতার হোসন লিমিটেডের বিরুদ্ধে নানা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। সোমবার ১৬ মে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) কোম্পানিটির বেশ কয়েকজন শেয়ারহোল্ডার প্রমাণসহ অভিযোগ দাখিল করেছে। অভিযোগটি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে সঠিক তদন্ত করে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বিএসইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আমরা মীর আখতার হোসেন লিমিটেড কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার। আপনার কমিশনের হাত ধরে যে কয়টি কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম স্বনামধন্য কোম্পানি মীর আখতার হোসেন লিমিটেড। শুধু তাই নয় আপনার সময়ে অনুমোদনপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রিমিয়াম নিয়ে কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। অথচ বছর না পেরোতেই এর শেয়ার মূল্য আইপিওতে আসা কাট-অফ মূল্যের নিচে চলে গেছে।আইপিওতে আসা কাট-অফ মূল্যের নিচে চলে যাওয়ায় এই কোম্পানির সকল সাধারণ বিনিয়োগকারী বড় ধরনের লোকসানে পড়ে গেছে।

আর্থিক প্রতিবেদনে অসঙ্গতি সমূহ:

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবার ১ বছর না যেতেই কোম্পানির আয়ে বড় ধরনের পতন দেখা গেছে। কোম্পানি কর্তৃক প্রকাশিত ২০২২ সালের ৩য় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় গত বছরের তুলনায় ৩য় প্রান্তিকে কোম্পানির ৮০% আয় কমে গেছে। ৩য় প্রান্তিকে কোম্পানি EPS দেখিয়েছে মাত্র ২৭ পয়সা যেখানে গতবছর ছিল ১ টাকা ২৮ পয়সা।৩য় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করতে গিয়ে বেশ কিছু অসঙ্গতি দেখা গেছে যা আপনার কাছে তুলে ধরা হচ্ছে।

১) হিসাববিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে General and Administration Expense একটি খরচ খাত তাই এটি লাভ-ক্ষতি হিসেবে Gross Profit থেকে বাদ যায় অথচ এখানে Gross Profit এর সাথে General and Administration Expense যোগ করা হয়েছে যা কোন ভাবেই সম্ভব নয়।তাছাড়া টাকার যে পরিমান উল্লেখ করা হয়েছে তাও সন্দেহ জনক। কোম্পানি কিভাবে General and Administration Expense আয় হিসেবে দেখিয়ে Gross Profit এর সাথে যোগ করেছে সেই বিষয়েও আর্থিক প্রতিবেদনে কোন ব্যাখ্যা দেয়নি।

২) সর্বশেষ প্রাপ্ত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, আইপিওর ৬৭ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা কোম্পানির ব্যাংক একাউন্টে দেখানো হয়েছে। যার বিপরীতে কোন ইন্টারেস্ট আয় দেখানো হয়নি এবং এর জন্য আর্থিক প্রতিবেদনে কোন ব্যাখ্যাও দেয়া হয়নি।

৩) কোম্পানি তৃতীয় প্রান্তিকে নিজস্ব কনস্ট্রাকশন ব্যবসা থেকে ট্যাক্স পূর্ববর্তী আয় দেখিয়েছে ২ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। এই আয়ের বিপরীতে কোম্পানি ট্যাক্স দেখিয়েছে ১ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা যা আয়ের ৭০ শতাংশ। কোম্পানির আয়ের তুলনায় ট্যাক্স প্রদানের হার বোধগম্য নয় এবং ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
৪) কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কোম্পানির মূল আয় আসে Joint Venture প্রকল্প থেকে। অথচ আর্থিক প্রতিবেদনে Joint Venture প্রকল্প গুলোর আয়-ব্যয় সহ কোন ধরনের তথ্য প্রকাশ করা হয়না যা একটি অস্বচ্ছ আর্থিক প্রতিবেদন হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

৫) তৃতীয় প্রান্তিক আর্থিক প্রতিবেদনের প্রাপ্ত তথ্য মতে ২০২১ সালে Joint Venture প্রকল্পে কোম্পানির বিনিয়োগ ছিল ১০০০ কোটি টাকা, সেখানে ২০২২ সালে এসে দেখা যাচ্ছে Joint Venture প্রকল্পে কোম্পানি বিনিয়োগ বেড়ে হয়েছে ১৩৩২ কোটি টাকা। Joint Venture প্রকল্পে কোম্পানি ৩৩% বিনিয়োগ বাড়ালেও গত বছরের তুলনায় তৃতীয় প্রান্তিকে Joint Venture প্রকল্প থেকে কোম্পানির আয় ৮০% কমে গেছে।২০২১ সালে Joint Venture প্রকল্প থেকে আয় করেছিল ১১ কোটি টাকা সেখানে চলতি বছর আয় করেছে মাত্র ২ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা যা অত্যন্ত সন্দেহ জনক এবং ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
দিয়েছে সেটিও অসামাঞ্জস্য এবং অগ্রহনযোগ্য। লোনের ইন্টারেস্ট খরচ বেড়ে যাওয়াকে কোম্পানি আয় কমার কারন হিসেবে উল্লেখ করেছে। অথচ গত বছরের তুলনায় কোম্পানি চলতি বছর ৩য় প্রান্তিকে কম ইন্টারেস্ট প্রদান করেছে।

তালিকাভুক্ত হবার পূর্বে এবং পরের আয়ে বড় বৈষম্য:

গত ২ বছর করোনার কারনে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হলেও চলতি বছর জানুয়ারি মাস থেকে দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। অথচ জানুয়ারি থেকে মার্চ এই সময়ে কোম্পানির আয় ৮০% কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারী হিসেবে আমরা উদ্বিগ্ন এবং সন্দিহান। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবার আগে ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে মীর আখতারের EPS ছিল ৫ টাকার উপর, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে EPS ছিল ৬ টাকার উপর। সেখানে তালিকাভুক্ত হবার ১ বছর না যেতেই ৩য় প্রান্তিকে EPS দেখিয়েছে মাত্র ২৭ পয়সা। ২০১৯ সালের প্রাপ্ত তথ্য মতে Joint Venture এবং নিজস্ব প্রকল্পে কোম্পানির বিনিয়োগ ছিল ৭৩৮ কোটি টাকা। ৭৩৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সেই বছর কোম্পানি শেয়ার প্রতি আয় করেছিল ৬ টাকার উপর অথচ ২০২২ সালে কোম্পানি ১৩৮২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তৃতীয় প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি আয় দেখিয়ে মাত্র ২৭ পয়সা যা টাকার অংকে মাত্র ৩ কোটি। ২০১৯ সালে ব্যাংক ইন্টারেস্ট ছিল অনেক বেশি এবং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না থাকার জন্য কোম্পানির ট্যাক্স সুবিধা ছিল না। সেখানে ২০২২ সালে কম ইন্টারেস্ট, কম ট্যাক্সের পাশাপাশি দিগুণ বিনিয়োগ করার পরও আয় কমে যাওয়ায় সাধারন বিনিয়োগকারী হিসেবে আমাদের কাছে বিষয়টি যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি অধিকতর তদন্ত এবং ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

নুতন চুক্তি সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের অবহিত না করাঃ

মীর আক্তার হোসেন লিমিটেড একটি ঠিকাদার কোম্পানি, তাই এই কোম্পানির উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে বিনিয়োগকারিদের ধারনা করা সম্ভব নয়। কোম্পানিটি মূলত টেন্ডারের মাধ্যমে সরকারের সাথে চুক্তি করে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ করে।নুতন প্রকল্পের কাজ নেয়ার সময় কোম্পানি অবশ্যই তার সম্ভাব্য লাভ-লোকসান হিসেব করেই কাজ নিয়ে থাকে।তাই নুতন কোন প্রকল্পের কাজ পেলে তার সম্ভাব্যতা যদি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রকাশ না করে তাহলে বিনিয়োগকারিদের পক্ষে কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিরুপন করা অসম্ভব। তালিকাভুক্ত হবার পর মীর আখতার বেশ কয়েকটি বড় বড় প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ পায়।

পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি মাগুরা থেকে ফরিদপুরের মধুখালি পর্যন্ত নুতন রেল লাইন নির্মাণে চায়না কোম্পানির সাথে যৌথ ভাবে কাজ করার চুক্তি করেছে মীর আখতার হোসেন লিমিটেড। প্রকল্পটি হাজার কোটি টাকার। চলতি বছর মার্চ মাসের ২২ তারিখ কচুয়া-বেতাগী-পটুয়াখালী-লোয়ালিয়া-কালাইয়া সড়কে পায়রা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য রাজধানীর সেতু ভবনে মীর আখতার এবং কোরিয়ান কোম্পানির সাথে চুক্তি সম্পাদন হয়। এই সেতু নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১০৪২ কোটি টাকা। এই ধরনের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প থেকে কোম্পানির আয় কত হবে, ব্যয় কত হবে বা মুনাফা কত হবে তার সম্ভাব্যতা বিনিয়োগকারিদের পক্ষে ধারনা তো দূর, কল্পনা করাও সম্ভব নয়। অথচ কোম্পানি তাদের নুতন প্রকল্পের চুক্তিগুলো সম্পর্কে কখনই বিনিয়োগকারীদের অবহিত করে নাই বিষয়টি বিনিয়োগকারিদের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগ জনক। তাই কোম্পানি যেন তাদের চুক্তি গুলো সম্পর্কে বিনিয়োগকারিদের অবহিত করে সেই বিষয়ে আপনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ না করাঃ

মীর আখতার হোসেন লিমিটেড ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। তালিকাভুক্ত হবার পর ২০২১ সালের মার্চ মাসে প্রায় ৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে “মীর সিকিউরিটিজ লিমিটেড” নামে একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি গঠন করে। অথচ এই বিষয়ে কোম্পানি স্টক এক্সচেঞ্জে কোন মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (PSI) প্রকাশ করেনি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পূর্বে তার কোন আর্থিক প্রতিবেদনে “মীর সিকিউরিটিজ লিমিটেডে” বিনিয়োগের বিষয়টি উল্লেখ নেই।পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবার পর তার আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করতে গিয়ে সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে তার বিনিয়োগের বিষয়টি জানতে পারি। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি সংবেদনশীল তথ্য (PSI) প্রকাশ না করে বিনিয়োগকারীদের এক ধরনের অন্ধকারে রাখার চেষ্টা করেছে যা সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূত। চলতি বছর মার্চ মাসে কোম্পানি একটি মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (PSI) প্রকাশ করে। এই মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (PSI) ছিল অস্পষ্ট।

মূল্য সংবেদনশীল তথ্যে (PSI) বলা হয় মীর আখতার হোসেন লিমিটেড “মীর স্টিল মিলস লিমিটেড” নামে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি গঠন করবে যার সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ার থাকবে মীর আখতারের কাছে। “সংখ্যাগরিষ্ঠ” শব্দটি অস্পষ্ট এখানে কোম্পানিকে অবশ্যই কত শতাংশ শেয়ার মীর আখতারের কাছে থাকবে তা সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা উচিত ছিল। অস্পষ্ট মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (PSI) প্রকাশ এবং মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (PSI) গোপন করে কোম্পানি সুস্পষ্ট আইন ভঙ্গ করেছে তাই এই বিষয়ে আপনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণে ট্যাক্স সুবিধা এবং দেশে বর্তমানে ইন্টারেস্ট রেট সিঙ্গেল ডিজিট করে দেওয়ায় মীর আক্তারের আয় বিগত বছরের থেকে উন্নতি করার কথা ছিল কিন্তু বাস্তবে আমরা এর ভিন্ন চিত্র দেখতে পাচ্ছি। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে তাতে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে কোম্পানিটি এক প্রান্তিকে মাত্র ৩ কোটি টাকা আয় দেখিয়েছে। যার কারণে বিনিয়োগকারী হিসেবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।

বর্তমান কমিশন পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় নিরন্তর পরিশ্রম করে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিনিয়োগকারীদের লিখিত আপত্তিগুলো আমলে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করার জন্য অনুরোধ জানান ভুক্তভোগিরা।

About the author

Pujibazar Express

Leave a Comment